বছর বছর নতুন বিভাগ খুলে বড় হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী বেড়েছে, শিক্ষক বেড়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক প্রশাসনিক কর্মী। সব মিলিয়ে কলেবরের দিক দিয়ে বিশাল আকার নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সমস্যা হলো, শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গুণগতমানের দিক দিয়ে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। পড়াশোনা ও গবেষণার মান, উদ্ভাবন, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষার্থীদের আবাসন–সুবিধা, বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পিছিয়ে। এসব কারণে বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক অবনতি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে গবেষণাকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) সর্বশেষ র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের ১ হাজার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। ২০১২ সালেও ৬০১তম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিসিএসসহ সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করেন। বিভাগের পড়াশোনার দিকে মনোযোগ কম। নতুন বিভাগ খোলার ফলে লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষকদের। তাঁরা পদ পেয়েছেন। দলীয় আনুগত্যের প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে শিক্ষক–রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীদের অবস্থান শক্ত হয়েছে।
শিক্ষার মান, গবেষণা ও উদ্ভাবন নিয়ে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার তেমন কিছু নেই। গর্বের বিষয় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও অতীতের ছাত্ররাজনীতি। বর্তমান উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান অবশ্য গর্ব করার মতো বিষয়ের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর, কম খরচে পড়াশোনা ও শিঙাড়া-সমুচার দামও যুক্ত করছেন। ২ অক্টোবর ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সামান্য টাকায় পড়াশোনার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘ইটস অ্যামেজিং, রেকর্ড।’ আলোচনা সভাটির শিরোনাম ছিল, ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এ আমার অহংকার—এখনই সময় দায়মোচনের’। অনুষ্ঠানে উপাচার্য আরও বলেন, বিদেশি প্রতিনিধিরা এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবরের কথা শুনে অবাক হয়ে যান। তাঁরা বলেন, ‘ইটস আ হিউজ অ্যান্ড ম্যাসিভ ইউনিভার্সিটি।’
এর আগে গত বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়ায় ১০ টাকার প্যাকেজে এক কাপ চা, একটি করে শিঙাড়া, সমুচা ও চপ পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও গর্ব করেন উপাচার্য। বলেন, ‘এটি আমাদের গর্ব, এটি আমাদের ঐতিহ্য।’ যদিও সামান্য টাকায় পড়াশোনা, চা-শিঙাড়ার দাম কম হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকার জোগান দেয় দেশের মানুষ।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি হবে আগামী বছর। শতবর্ষে এসে বিশ্ববিদ্যালয়টি আরও শিক্ষা–গবেষণায় ম্রিয়মাণ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রগতি যতটুকু হওয়ার কথা ছিল, ততটুকু হয়নি—এটা সত্য। গবেষণায় কম বরাদ্দ, ইংরেজি ভাষাগত দুর্বলতা, নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে রাজনীতি ইত্যাদি কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা-পড়াশোনা-গবেষণার সংস্কৃতি উন্নত হয়নি। এসব সমস্যা না থাকলে ‘গ্রাফটা’ আরও তাজা হতো। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা-পড়াশোনার জন্য পরিবেশ নেই, প্রণোদনা নেই, বিনিয়োগ নেই, রাষ্ট্রীয়ভাবে একে নিরুৎসাহিত করা হয়; তবু যে গবেষণা হচ্ছে, তাতে আমি আনন্দ পাই।’
বছর বছর নতুন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি প্রতিবছরই নতুন বিভাগ খোলা হয়। তবে বিভাগ খোলা, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়ানো হয়েছে মূলত বিগত দুই দশকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র অনুযায়ী, ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের সংখ্যা ছিল ৪৭। এখন ৮৪টি। দুই দশকে ৯টি থেকে বেড়ে ইনস্টিটিউট হয়েছে ১২টি। সাড়ে ২২ হাজার থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। শিক্ষক বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
এ ছাড়া দুই দশকে ১৬টি থেকে বেড়ে গবেষণাকেন্দ্র ও ব্যুরো হয়েছে ৫৬টি। প্রশাসনিক কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪১৭। ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স আছে। নিয়মিত শিক্ষার্থীর বাইরে বিভিন্ন কোর্সে সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তাঁদের ক্লাস নেন ৭২৫ জন শিক্ষক। এটা শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের একটি উৎস। তবে অভিযোগ রয়েছে, দিন-রাত ক্লাস নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণায় কম মনোযোগ দেন শিক্ষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, বিভাগ ও ইনস্টিটিউট সংখ্যার জন্য যে পরিমাণ জায়গা (ফ্লোর স্পেস) প্রয়োজন, তার চেয়ে বর্তমানে কম রয়েছে ১৩ লাখ বর্গফুটের মতো। এ ছাড়া সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশের জন্য পাঠাগার–সুবিধা, আধুনিক গবেষণাগার, আবাসন ও পরিবহনসেবার প্রয়োজন। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে রয়েছে। এ জন্যই শিক্ষার দিক দিয়ে উন্নতি করা যাচ্ছে না। তিনি জানান, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
নতুন নতুন বিভাগ খোলার কারণে কলা ভবনে এখন শ্রেণিকক্ষ পাওয়াই দুষ্কর। সংস্কৃত এবং পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের নিজস্ব কোনো শ্রেণিকক্ষ নেই। এ দুই বিভাগ পালা করে একই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং উর্দু বিভাগেরও শ্রেণিকক্ষ নেই। সংকট রয়েছে প্রায় সব বিভাগেই। বহুসংখ্যক শিক্ষকের নিজস্ব কোনো কক্ষ নেই। অভিযোগ রয়েছে, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন, তাঁরাই নিজস্ব কক্ষ পেতে অগ্রাধিকার পান।
শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের কক্ষের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন জানান, তাঁর বিভাগের জন্য শ্রেণিকক্ষ আছে একটি। আর ২০ জন শিক্ষকের বিপরীতে কক্ষ আছে আটটি। একটি কক্ষ একাধিক শিক্ষক ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, পরীক্ষার খাতা বাসায় নেওয়া যায় না। অথচ খাতা দেখার জন্য শিক্ষকদের কক্ষ থাকে না। এমন নানা সমস্যায় পড়তে হয়।২০১২ ও ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের উদ্যোগে দুটি নতুন বিভাগ খোলা হয়—টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ এবং প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস স্টাডিজ বিভাগ। ২০১৩ সালে খোলা যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের (কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস) পড়াশোনা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কাছাকাছি ধরনের।
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগটি খোলা হয় ২০১২ সালে। আগে থেকেই সাংবাদিকতা বিভাগে টেলিভিশন, ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ানো হতো, এখনো হয়। নতুন করে বিভাগ খুলে সেখানে চেয়ারম্যান ও শিক্ষক হন সাংবাদিকতা বিভাগেরই শিক্ষক ও একই বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে বিভাগটিতে পূর্ণকালীন শিক্ষক ছয়জন, যাঁদের পাঁচজনই সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের একটি ব্যাচ ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে, যেখানে শিক্ষার্থী ছিলেন ২৩ জন। এঁদের মধ্যে ১৩ জনের বর্তমান পেশা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, শিক্ষাজীবনের দুই বছর শেষে এখনো পাঁচজন বেকার (সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন), সিনেমাটোগ্রাফার ও ফটোগ্রাফার হয়েছেন তিনজন, দুজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, একজন রাজনীতি করছেন এবং দুজন ব্যবসায়ী। ওই ব্যাচের শিক্ষার্থী সাঈদ শাহজাদা আল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য বিসিএস বা সরকারি চাকরি। এ জন্য পড়াশোনার মনোযোগও সেদিকে।
প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস স্টাডিজ বিভাগটি খোলা হয় ২০১৫ সালে। এর প্রথম চেয়ারম্যান সুধাংশু শেখর রায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে পাঁচজন পূর্ণকালীন শিক্ষকের সবাই সাংবাদিকতা বিভাগ থেকেই পড়াশোনা করা। সাংবাদিকতা বিভাগে পড়া শিক্ষকেরা মুদ্রণ ও প্রকাশনার বিষয়ে কী পড়ান, এ বিভাগটি খোলার প্রয়োজন ছিল কি না, জানতে চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান সুধাংশু শেখর রায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশনার জগৎ, মুদ্রণের জগৎ বিশাল। যেখানে সাময়িকী, বই, দ্রব্যের লেবেল, পোশাকের লেবেল, চিকিৎসাসামগ্রী প্রকাশনার বিষয় আছে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষকেরা বিভাগে যোগ দেওয়ার পর তাঁদের ছয় মাস প্রিন্টিং ও পাবলিকেশন বিষয়ে শেখানো হয়েছে।
0 Comments